-->

অমৃত নির্ঝর রবীন্দ্র-নাটক - ড. চঞ্চলকুমার মণ্ডল

 

অমৃত নির্ঝর রবীন্দ্র-নাটক

জীবনে আমার যত আনন্দ

পেয়েছি দিবস রাত

সবার মাঝারে তোমারে আজিকে

স্মরিব জীবন নাথ।...

রবীন্দ্র-সৃষ্টি ধারায় জীবনের আনন্দ ভোজের আয়োজন অন্তহীন। প্রতিটি সৃষ্টি ধারায় কবি-চিত্তের দার্শনিক অনুভূতি, জীবনের বিচিত্র রূপ-রঙ-রস মাধুর্যের সংরাগ নানাভাবে আমাদের হৃদয়কে করে তোলে আন্দোলিত। জাগায় জীবনবোধ ও প্রজ্ঞানুভূতিতে বেঁচে থাকার ভীষণ রকম প্রেরণা-অনুকম্পা। বিশ্বমানবের চিত্তলোকে জড়তা ঘুচিয়ে শ্রী ও সৌন্দর্যানুভূতি জাগিয়ে তোলার পথ প্রদর্শক তিনি। বিশ্বের প্রতিটি সংকট মুহূর্তে প্রেরণার অমৃত নির্ঝর অভয় বাণীর উদ্গাতা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। এক কথায়, রবীন্দ্রনাথ নইলে শুধু বাঙালী কেন সমগ্র বিশ্ববাসীই অনাথ। শয়নে-স্বপনে, চিন্তায়-কর্মে জাগরণে----অমৃত নির্ঝর  রবীন্দ্র-বাণীই বিশ্বমানব সংসারের সংগ্রামী জীবন পথের প্রেরণার বিশল্যকরণী রূপ সঞ্জীবনী সুধা মন্ত্র। তাঁরই সৃষ্টি ধারায় খুঁজে পাওয়া যায়, অমৃতত্ত্বের পথ। পুরাণ কথার নব আদর্শ মূর্তি গড়ে তোলায় বেদ-উপনিষদ-মহাভারত থেকে শান্তির পূজারী গৌতম বুদ্ধের আদর্শ ও ভারতাত্মার শাশ্বত বাণী----রবীন্দ্র-সৃষ্টি ধারায় অমৃত নির্ঝর রূপে বর্ষিত হয়ে চলেছে কাল থেকে কালান্তরের পথে। ঋষিকল্প রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুর অনুষঙ্গে দিয়েছেন অমৃতত্ত্বের সন্ধান। তাই তো তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারেন----

মৃত্যুর অন্তরে পশি অমৃত না পাই যদি খুঁজে,

সত্য যদি নাহি মেলে দুঃখ সাথে যুঝে।

আর তাই তিনি যুগান্তরের কবি রূপে মৃত্যুর দ্বান্দ্বিকতার মধ্য দিয়েও দিয়েছেন অমৃতত্ত্বের আস্বাদ। ন্যায় ও সত্য ধর্ম প্রতিষ্ঠার সংকল্পে আজীবন তিনি বিশ্ব মানবলোকের চৈতন্যের মূলে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার দীপশিখা জ্বালিয়ে গেছেন। ছদ্মধর্মের সঙ্গে সত্য ও ন্যায় ধর্মের বিরোধের মধ্যদিয়ে বিশ্ব মানব লোকের সুমহান আদর্শ ও কল্যাণ বোধের রূপটি প্রতিস্থাপিত করেছেন। বিশ্ব মানবলোকের চিন্তা ও কর্ম প্রবাহে উপনিষদীয় ঋষিবাক্য রূপে ধর্মভাবনায় কোনো তর্কজাল রচনা করেননি। কোনো জটিল তত্ত্ব কথায় বিরোধ-বিচার না করে মানব চিত্তদেশের গভীর অন্তর্লোকে শান্ত-সমাহিত ভঙ্গিতে ধর্ম ভাবনার সত্য রূপ, বোধ-বোধি, জ্ঞান-চিন্তার শ্রেষ্ঠ মনীষা রূপে জাগিয়ে তুলেছেন। নারীর কল্যাণ মূর্তি বিশ্ব সভ্যতার অগ্রগতিতে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে, এবং পুরুষের চিত্তদেশে সমস্ত রকম জড়তা-মূঢ়তার অন্ধকার ঘুচিয়ে উত্তরণের আলোকশিখা জ্বালিয়ে দিয়ে- সেই মানব সংসার লোকের দ্বারে সত্য-আদর্শ রূপটি প্রতিস্থাপিত করেছেন মহীরুহ প্রতিভাধর, জ্ঞানী শ্রেষ্ঠ----শাশ্বত মানব-জীবন বাণীর চিরন্তনের অমৃতমন্ত্র উদ্গাতা; জীবন পথের সত্যানুসন্ধানী ভারতাত্মার অমৃতমন্ত্র বর্ষণকারী রবীন্দ্রনাথ। বিপন্ন মানব সভ্যতাকে সংকট থেকে উত্তরণের অভয়মন্ত্র হিসেবে যিনি শোনান অমৃত নির্ঝর সুধা সংগীত----

দুঃখ যদি না পাবে তো দুঃখ তোমার ঘুচবে কবে।

বিষকে বিষের দাহ দিয়ে দহন করে মারতে হবে।

মরতে মরতে মরণটারে শেষ করে----দে একেবারে

তারপরে সেই জীবন এসে আপন আসন আপনি লবে।

রবীন্দ্র-সৃষ্টি ধারা ফুলে-ফলে সহস্র শাখা-পল্লবে পূর্ণ, ঝলমলে আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে বিশ্ববাসীকে যুগিয়ে চলেছে সেই অমৃতত্ত্বের আস্বাদ। বেদ-উপনি¡্দীয় তত্ত্বরূপের ভাব-রসবোধে যে এক অমৃত নির্ঝর বাণীশিল্প রচনা করেছেন, নাট্য শিল্প তারই অন্যতম এক গুরুত্বপূর্ণ পল্লবিত শাখা বিশেষ। নাট্য শিল্পের এই উচ্চাঙ্গ শাখায় বিচরণ করে বিপুল মহীরুহ রবীন্দ্র-সৃষ্টি প্রতিভাকে স্পর্শ করার স্পর্ধা কিম্বা, জ্ঞান-মেধা-পাণ্ডিত্যের বিপুল শক্তি আমার নেই। অসংখ্য রবীন্দ্র-সাহিত্যের প্রাজ্ঞ-স্থিতধী সমালোচকগণ এই বিরল প্রতিভাবানের সৃষ্টি ধারায় স্বচ্ছন্দে পদচারনা করে, তাঁদের সুচিন্তিত যুক্তি-যুক্ত সমৃদ্ধপূর্ণ মতামত ও পাণ্ডিত্যের স্বাক্ষর রেখেছেন। সেই সকল সমালোচকগণের বিচার-বিশ্লেষণ পদ্ধতি আর তথ্যপূর্ণ দৃষ্টান্ত বহুল অভিমতকে শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করে, কেবল রবীন্দ্র-সাহিত্যের একজন সামান্য অনুরাগী পাঠক হিসাবে; রবীন্দ্র-নাট্যানুভূতির বিশেষ কয়েকটি মাত্র দিক দৃষ্টান্ত স্বরূপ তথ্য-সমাহারে আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি

পর্ব-১

বিপর্যয় থেকে উত্তরণ     

দাম্পত্য-সংকট ও উত্তরণ 

বাল্মীকি প্রতিভা : জীবন পথের উত্তরণ 

পর্ব-২

নির্মাণে-বিনির্মাণে মহাভারত অনুষঙ্গ     

লৌকিক দেবদেবী        

ধর্ম ভাবনা : রাজ ইতিহাসের আলোকে      

ছদ্মবেশ : ক্ষুদ্র ছদ্মধর্ম বনাম শাশ্বত মানবধর্ম     

পর্ব-৩

জাতপাতের ব্যাকরণ      

‘চণ্ডালিকা’ : ব্রাত্য জীবনের রুদ্ধসংগীত     

সংস্কার ও সংস্কার হীনতার আলপনা      

পর্ব-৪

প্রেম ও জৈবিক চেতনায় নারী        

নাট্য দ্বন্দ্বের নিরসনে নারী      

স্থানিক দ্বন্দ্ব                  

মৃত্যুর দ্বান্দ্বিকতা            

পর্ব-৫

মৃত্যুর অমরতা               

সুন্দর ভাবনা              

লোকায়ত অনুষঙ্গ 

 

গ্রন্থের যা কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমাসু¨র দৃষ্টিতে দেখে যদি রবীন্দ্র-নাট্যানুভূতির কিছু অংশ রবীন্দ্র-অনুরাগী পাঠক-গবেষকগণের সামান্য উপকারে লাগে তাহলে বুঝবো আমার দীর্ঘ সাধনা সফল হয়েছে।